Book review

আসমান


পাঠক প্রতিক্রিয়া – ৭১

কোন একটা শহর , তার মধ্যে কোন এক ছোট্ট জায়গা জুড়ে রয়েছে আর ও একটা গোপন শহর । যার ভেতরে শুধুই আনাগোনা দেয় কিছু সংখ্যক নিষিদ্ধ ও জীবন কে তুচ্ছ করে চলা কিছু মানুষ। এদের কে নেতৃত্ব দেয় একজন মানুষ , যিনি এই জগতে ভাই নামেই সমাহিত হন। যিনি যত বেশী সাহসী ও হিংস্র তিনি তত বেশি নামী। অর্থাৎ ডেভিড দের মত। যার দুই হাতের এক হাতে থাকে অস্র অন্য হাতে থাকে ক্ষনিকের মহা ক্ষমতা । খুবিই অবাক হবেন, আমি ছোট বেলা থেকেই ডেভিড এর মত হতে চাইতাম, খুব চাইতাম। কালের আগ্রাসনে ও সময়ের টানে সব কিছু হারিয়ে যায়, হারিয়ে যায় ছোট বেলা ও পটে আকা ছবি গুলোর রঙ শুকিয়ে যায়। আমি বড় হয়ে যাই, ইউনিভার্সিটি লেভেল শেষ করে বড় হয়ে যাই। ঠিকক তখনি গত বই মেলায় আমার প্রিয় মানুষ , ছোট বেলা যার লেখা গান গুলো শুনে অভ্যস্ত তার একটি বই চোখে পড়ে। “দখল” নাম। বইটি পড়ে আমার মনের অজানা ও অপরিনামদর্শী স্বপ্নের দেখা পেয়ে যাই।

তারপর থেকেই এই মানুষটার জন্য ভাললাগা শুরু,,,,,

কোন লেখকের সব লাইন ই অথবা সব উপন্যাস যে খুব বেশি আপনার কাজে আসবে তেমনটা না। আপনি জানেন কি হয়তো কোন একজন লেখকের কোনটা লাইন ই আপনার জীবন কে বদলাতে সাহায্য করতে পারে। ঘটনায় যাই। ব্যক্তিগত ভাবে প্রেমিক হিসেবে সবাই সাফল্যের দেখা পায় না। সবাই সফল ও হন না। ঠিক এমন সময়ে যারা ব্যর্থ হন, তারা জীবনের হিসেব না মিলাতে না পেরে বেছে নেন খারাপ কোন পথ। কেউ বা আবার নেশার জগতে হারিয়ে ফেলে,হারিয়ে যায় ছোট্ট বেলায় নিজেকে বড় করে দেখা সেই সুন্দর স্বপ্নগুলোকে। আমাদের পরিবার হারিয়ে ফেলে তাদের প্রিয় সন্তানকে। ঠিক এমন এক পরিস্থিতি আমাকে তার গোগ্রাসে গিলে ফেলতে চেয়েছিল। ভালবাসা অথবা প্রেমের অর্থ বুঝতে চাইতাম প্রেমে সফলতা দিয়ে। কিন্ত নারী চান নিশ্চিয়তা,চায় নির্ভরতা। এগুলোর কোনটায় আমার ছিল না,, নিজেকে একজন ভুল মানুষের সাথে জড়িয়ে শেষ করে দিতে চেয়েছিলাম। এমন সময়ে শিবলী ভাইয়ের আসমান নামক বইটা পড়ে যেতে থাকি। আল্লাহর কি রহমত আমার উপর,,বইয়ের যত পৃষ্ঠা শেষ করি ততই,, নিজের প্রতি নিজের ভালবাসা বাড়তে থাকে।

পড়ে যেতে থাকি l নিজের প্রতি ততই ভালবাসা বাড়াতেই থাকি l
আসমান আমাকে হাতে আংগুল দিয়ে শিখিয়েছে ভালবাসা কি ? প্রেম কি ? সসীম আর অসীম প্রেমের সুন্দর ও বস্তনিষ্ঠ সংগায় কিভাবে মহান রাব্বুল আলামিন কে কাছে পাওয়া যায় l

জাগতিক নর নারীর প্রতি ভালবাসা ও টানে আমরা ইমোশনাল হয়ে যাই,এটাকে প্রেম বলি ,এটাকে আমরা যখন আর ও নোংরামো তে নিয়ে অবৈধ শারীরিক খেলায় মেতে উঠি তখনি এটা জাগতিক সফল ভালবাসা হয়ে যায় , আমাদের মাঝে অস্থিরতা ও সম্পর্ক ভাংগার চরম অনিচ্ছাকৃত অনিচশয়তা বিরাজ করে l কেননা প্রেম শুধু আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এর জন্য থাকে , যার প্রেম ও খোদাভীতি যত বেশী তার অন্তর তত বেশী শীতল ও পবিত্র l

নিজে যখন কোন সমস্যার সমাধান পরিবার কে বলতে পারি না , আসমান আমাকে তখনি সেই সমস্যার সমাধান পেতে সাহায্য করেl মনেহয় আসমান আমার জন্যই লেখা l আসমান তুমি আমাকে সমস্যার সমাধান দিয়েছ ,আমিও তোমার আদর্শ নিয়ে ও ধারণ করে ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য নিজেকে নিয়োজক করে নিলাম l

নিয়মিতভাবে সালাত আদায় কুর আন ও ইসলামের খাদেম হতে চেষ্টা করে যাব ,,,

কথা দিলাম ,,,,,আসমান তোমাকে l

Fahim Zaher

Article link

 

পাঠক প্রতিক্রিয়া – ৭২

[লেখাটা কোনো সাহিত্য সমালোচনা নয়; জাস্ট একজন সচেতন পাঠকের পাঠ-প্রতিক্রিয়া!]
আসমান: যে গল্প জীবনের চেয়েও বড়
————
একজন লেখক কি শুধু কলমের তুলিতে যাপিত জীবনের গল্প এঁকে যাবেন?
নাকি গল্পের মধ্য দিয়ে, বর্ণনার মধ্য দিয়ে, চরিত্রের বুলিতে জগৎ ও জীবন সম্পর্কিত অচর্চিত দর্শন, বোধ ও ঘটনার গভীরে লুকিয়ে থাকা গভীরতম শিক্ষা এবং স্বপ্নের কথাও বলবেন?
আমার গত তেত্রিশ বছরের পাঠক জীবনের প্রায় দুই যুগ ই এই প্রশ্ন করে করে কেটে গেছে! তাই আমি এখন (সর্বভুক পাঠক হয়েও) বাছাইকৃত বই ছাড়া পড়তে অভ্যস্ত নই!
আমার আশেপাশের মানুষ জানেন, পাঠক হিশেবে আমি অনেকটাই উন্নাসিক হয়ে গেছি! কারণ, জীবনটা খুবই ছোটো। এই ছোট্ট জীবনে পৃথিবীর সব বই পড়ার সুযোগ আমি পাব না! তাই বই মানেই- “পড়ে দেখতে হবে” এমন বাসনা চেপে রেখে যাচাই-বাছাই করে পড়ার প্রবণতা তৈরি হয়ে গেছে প্রায় দেড় যুগ আগেই!
.
গত কয়েক বছর ধরে লেখক জনাব লতিফুল ইসলাম শিবলী-র নাম বহুবার বহুজনের মাধ্যমে আমার কানে এসেছে। যে কারণে সোশ্যাল মিডিয়ায় তাকে ফলোও করি। কিন্তু তার কোনো বই (গল্প, উপন্যাস বা কবিতা) পড়া হয়নি কখনো- যদিও তার লেখা গানগুলো শুনে শুনেই কৈশোর ও যৌবন পাড় করছি! কিন্তু পেশাগত কারণে বিষয়ভিত্তিক গবেষণাধর্মী বই-র ভারি ভারি, নিরস, প্রাণহীন লেখাগুলো পড়তে পড়তে যখন খুব হাঁপিয়ে ওঠে মন; তখন উপন্যাস অথবা কবিতার বুকে ঝাঁপিয়ে পরে মনটাকে শীতল হওয়ার সুযোগ দিতেই হয়! আর ঠিক তখনি আমি ফাঁপড়ে পড়ে যাই!
কে আছেন এমন ঔপন্যাসিক বা কবি- যার লেখা আমার নির্জীব হৃদয়টাকে একটু সজীবতা প্রদান করতে পারে?
নতুন নতুন হাজারো লেখকের জন্ম হচ্ছে এদেশেও। কিন্তু তাদের অধিকাংশের লেখা সাহিত্যমান বিচারে মানোত্তীর্ণ নয়! অন্তত আমি গত কয়েক বছরে নতুন বেশ ক’জন লেখকের বই কিনে, পড়ে বেশ আশাহত হয়েছি! তাই সহসাই প্রশ্ন জাগে মনে- আমরা কি তাহলে ঘুরেফিরে সেই রবীন্দ্র-র বুকেই ঝাঁপিয়ে পড়বো? নাকি দস্তয়েভস্কি, তলস্তয়, আলবেয়ার কামু, হেরমান হেস, অথবা আমাদের শরৎচন্দ্র বা জীবনানন্দের লেখার মাঝেই অতৃপ্ত আত্মার শান্তিপূর্ণ স্থিতি খুঁজে বেড়াবো?
.
কিছুদিনের মধ্যেই আমাদের মতো কয়েকজন তরুণ ও সাহিত্য-সাধক মানুষের একটি দূর্দমনীয় আবেগ, উচ্ছ্বাস ও স্বপ্নের বাস্তবায়ন ঘটতে যাচ্ছে। আমরা জন্ম দিতে যাচ্ছি অসাধারণ একটা প্রকাশনীর! তাই হালের সব ধরনের লেখকের বই সংগ্রহ করা ও পড়ার সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে আমাদের। এরই ধারাবাহিকতায় হাতে এসেছে জনাব লতিফুল ইসলাম শিবলী রচিত উপন্যাস “আসমান”! বইটি এক বসায় পড়ে শেষ করে এই প্রতিক্রিয়াটি লিখতে বসলাম! আশা করি লেখাটাকে সমালোচনা হিশেবে না দেখে- একজন সচেতন পাঠকের আবেগঘন পাঠ-প্রতিক্রিয়া হিশেবে দেখবেন।
.
” আসমান” একজন প্রেমাহত তরুণের ভাঙা হৃদয়ের প্রশান্তি অন্বেষণ ও এরই সুবাদে পুরোপুরি বদলে যাওয়ার গল্প। যে গল্পকে লেখক “জীবনের চেয়েও বড়” বলছেন।
শুরুতেই মনে ভয় ছিলো- না জানি কেমন হয় লেখার ধরণ! হয়তো দুই পৃষ্ঠা পড়েই বিরক্তি চলে আসবে মনে! কিন্তু পড়তে শুরু করে উপলব্ধি করলাম- এ গল্প যেনতেন লেখকের কলমের তুলিতে আঁকা কোনো শিল্পের নামে ফাতরামি নয়! নয় উপন্যাস বা গল্পের নামে তথাকথিত বাস্তবতা বর্ণনা করার কোনো ধারাভাষ্য। এ লেখায় গভীরতা আছে! গল্পের বর্ণনায়, কথোপকথনে গভীর জীবনবোধ তুলে ধরার অসাধারণ মুন্সিয়ানা আছে! সেই জীবনবোধ ও দর্শনের সাথে পাঠক একমত না-ও হতে পারে, কিন্তু লেখার গভীরতাকে, লেখায় যে চিন্তা উদ্রেক করার মতো উপাদান আছে- তাকে অস্বীকার করার উপায় নেই! যেমন উপন্যাসের একদম শুরুর কয়েকটি বাক্য এমন- “হৃদয় আল্লাহর ঘর। মানুষের হৃদয়টা তৈরি করা হয়েছে এই জন্য যে সেখানে শুধুমাত্র আল্লাহ থাকবেন। সে ঘরে আল্লাহ ছাড়া অন্য কিছু ঢুকালেই শুরু হবে তোমার জাগতিক অশান্তি।”
মহান লেখকদের গল্প বা উপন্যাসে যেমন দার্শনিক কোনো এক বা একাধিক চরিত্র থাকে- যার মাধ্যমে লেখক তার ফিলোসোফি তুলে ধরেন; “আসমান” উপন্যাসে তেমন ই এক চরিত্রের নাম মাওলানা ইসহাক আব্দুর রহমান। একদম শুরুতে এই মাওলানা সাহেবের মুখ থেকে উচ্চারিত বাক্যগুলোর ব্যাখ্যা পাওয়া যায় আরেকটু এগুলেই। যেমন গল্পের নায়ক ওমার রিজওয়ান ও মাওলানা ইসহাক আব্দুর রহমান এর গভীর কথোপকথনের এক পর্যায়ে মাওলানা তাকে “বিচ্ছেদের জ্ঞান” ও বিচ্ছেদ থেকে সৃষ্ট “মানসিক কষ্ট” বিষয়ে এক স্বর্গীয় দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে বোঝাচ্ছিলেন। তারপর ওমার এর প্রশ্ন “তা হলে কি মানুষ শুধু আল্লাহকেই ভালোবাসবে, কোনো মানুষ প্রাণী বা বস্তুকে ভালোবাসবে না? তাহলে ভালোবাসার অনুভূতি কেন সৃষ্টি করা হয়েছে?”- র জবাবে তিনি বলছিলেন, “…. ভালোবাসা মানে হচ্ছে রেসপন্সেবিলিটি বা দায়িত্ব। যখন তুমি কাউকে ভালোবাস তখন তুমি তার দায়িত্ব নাও। এই দায়িত্বটা তোমাকে কে দেন? তিনি দেন, যিনি তোমার হৃদয়ের ঘর জুড়ে বসে আছেন, তিনি সমস্ত বিশ্বজগতের মালিক, সৃষ্টিকর্তা। তিনি বলেছেন, জীবে দয়া কর আর তার সমস্ত সৃষ্টিকে ভালোবাস। সেটা শুধু কথার কথা ভালোবাসা নয়, সেই ভালোবাসা এক বিশাল দায়িত্ব। তাই তাঁর জন্য যখন ভালোবাসবে তখন এই সৃষ্টি জগতের কেউ তোমার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। তখন তোমার ভালোবাসা হবে পৃথিবীর আলো-বাতাস আর পানির মতো, যা সমস্ত পোকামাকড় জীবজন্তু থেকে শুরু করে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই সমান ভোগ করে। দেখ তুমি কতটা গুরুত্বপূর্ণ, এই বিশ্বজগৎ সৃষ্টি করা হয়েছে তোমার জন্য, আর তোমাকে সৃষ্টি করা হয়েছে তাঁর জন্য। তুমি যখন তাঁর হবে এই বিশ্বজগৎ সবকিছু তোমার হবে। তুমি যখন তাঁর হবে না তখন এই বিশ্বজগৎ সবকিছু তোমাকে বিচ্ছেদ বেদনা দেবে। তাঁর সাথে এই সম্পর্কটাই প্রকৃত প্রেম।…. এই প্রেমের জন্যই তোমাকে অসীম এবং অমূল্য এক বস্তু দেওয়া হয়েছে। যেটার নাম হৃদয়। সেই হৃদয়ের ব্যবহার আর প্রকৃত প্রেমের কায়দাটা শেখোনি বলে আজ এত কষ্ট পাচ্ছ।”
এমন বেশকিছু কথোপকথন আছে- যেখানে যে ফিলোসোফি তুলে ধরা হয়েছে তার সাথে সবাই একমত হবে না নিশ্চিত। কিন্তু ফিলোসোফি তুলে ধরার যে স্টাইল তা অসাধারণ ও অনবদ্য। যেমন ওমার এর মা গভীর রাতে বিচ্ছেদ-বেদনার ভারে নুয়ে পড়া ছেলেকে বলে, “…দুঃখ-কষ্টের ভার কেউ কারোটা বহন করতে পারে না। সেটা কাঁধে নিয়েই মানুষকে নির্দিষ্ট পথ আর সময় অতিক্রম করতে হয়। সাহসী আর বুদ্ধিমানেরা ধৈর্যের সাথে এই পথ আর সময়টুকু অতিক্রম করে। বোকারা চায় তার সেই ভার অন্য কারো কাঁধে কিছুটা তুলে দিতে। তোরা যেটাকে বলিস শেয়ার করা। মানুষের ভেতরের কষ্টটা অপার্থিব, আত্মিক, আধ্যাত্মিক। আত্মিক শক্তি সম্পন্ন কোনো মানুষ যদি তোর সেই কষ্টের সময়টুকুতে তোর বন্ধু বা চলার সাথি হয় তা হলে দেখবি তোর কষ্টের সময় আর পথ খুব দ্রুতই শেষ হয়ে যাবে। এর বাইরে দুর্বল অন্তরের বন্ধুরা তোর মনের আগুনে বাড়তি কিছু খড়কুটো তুলে দেওয়া ছাড়া কিছুই করতে পারে না। এছাড়া আদতে কষ্টের কোনো শেয়ার নেই।”
অথবা ওমার এর বন্ধু রুশো-র বলা “গানচর্চায় গুরু হয়ে ওঠা” বিষয়ক তত্ত্ব- “….শোন গুরু হতে হলে নিজস্ব দর্শন থাকতে হয়, সেই দর্শনের চর্চা থাকতে হয়। সেটা গানে গানে সুরে সুরে অথবা উপাসনার আকারে উদযাপিত হয়। একজন কথা লিখে দিবে অন্যজন সুর করে দেবে আর গায়ক লম্বা লম্বা চুল রেখে গাঁজা খেয়ে টলতে টলতে মঞ্চে সেই গান ডেলিভারি দিয়ে কয়েক হাজার ভক্তকে মাতিয়ে দিলেই গুরু হওয়া যায় না। গুরু হচ্ছে সে, যে নিজের কথা নিজের সুরে নিজের দর্শন-মতবাদ প্রচার করে। সময়ের সাথে সাথে সেই দর্শনকে ভক্তদের চর্চার ভিতর দিয়ে টিকে থাকতে হয়। এমন গুরু এই অঞ্চলে শুধু একজনই আছে সেটা লালন ফকির। আর পশ্চিমে আছে জিম মরিসন। কুষ্টিয়ার ছেউড়িয়াতে গুরু লালনের সমাধিতে যা ঘটে, একই ঘটনা ঘটে প্যারিসের প্যারল্যাসেইজ সিমেট্রিতে মরিসনের সমাধিতে।….”
“আসমান” উপন্যাসে এমন অজস্র কথোপকথন আছে যা থট-প্রভোকিং অথবা বলা যায়, চিন্তাশীল পাঠকের বুভুক্ষু হৃদয়ে আন্দোলন সৃষ্টি করতে সক্ষম। সেগুলোর উল্লেখ করতে গেলে লেখা আরো বড় হয়ে যাবে। তাই শেষ করতে হচ্ছে। কিন্তু বইটি (আমার দৃষ্টিতে) বিশ্বসাহিত্যের একটি ক্ষুদ্র পালক হয়ে ওঠার সক্ষমতা অর্জন করতে করতেও পেরে ওঠেনি বেশ ক’টা সীমাবদ্ধতার কারণে। যেমন- ওমার ও রুশো’র জীবনাচার ও কথোপকথন আমাকে বারবার নোবেলজয়ী জার্মান লেখক হেরমান হেস এর অনবদ্য সৃষ্টি “সিদ্ধার্থ”-র সিদ্ধার্থ ও গোবিন্দ-র কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিলো। মনে আশা জাগছিলো এই ভেবে যে- সিদ্ধার্থ ও গোবিন্দ যেভাবে যার যার মতো করে, যার যার বেছে নেয়া পথে, জীবনের গভীর তাৎপর্য ও নির্বাণ লাভের উপায় খুঁজে পেয়েছিলো; ঠিক তেমনি এই উপন্যাসেও বোধ হয় এই দুই বন্ধু অনন্য কোনো দর্শন খুঁজে পাবে। কিন্তু তা তো হয়ইনি বরং লেখক নায়ক ওমার কে তাবলীগের মাধ্যমে পাকিস্তান পাঠানো, সেখান থেকে আফগান তালেবানদের সাথে জেহাদে জড়ানো, আফগানিস্তানে নারী শিক্ষা বন্ধ হওয়ার ঠুনকো ও একেবারেই সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা শোনানো, আইএসআই কর্তৃক তালেবান সৃষ্টি হওয়ার বিষয়টা ভুল তথ্য- এটা জানানো সহ মাঝখানে যা যা করিয়েছেন, যা যা দেখিয়েছেন তা যে কোনো উন্নত পাঠকের জন্য ই আশা ভঙ্গের কারণ হবে! এমনকি পাকিস্তানের পথে যাত্রা শুরুর পর থেকে শেষ পর্যন্ত মাওলানা ও রুশো-র মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্যারেকটারদ্বয়কে আর সিনেই আনা হয়নি। অথচ লেখক যদি যুদ্ধের ময়দানে অথবা আহত অবস্থায় বছর দেড়েক নায়িকার বাড়িতে থাকা ওমার এর মাধ্যমে রুশো ও মাওলানা কে চিঠি লিখেও ওমার এর বোধ ও উপলব্ধিগুলোর বর্ণনা দিতেন তাহলেও হয়তো ওমারের এমন একশ আশি ডিগ্রি পরিবর্তন এবং আফগানিস্তান, আইএসআই, তালেবান বিষয়ক নতুন দৃষ্টিভঙ্গির যৌক্তিক ও হৃদয়গ্রাহী ব্যাখ্যা পাওয়া যেত। সেইসাথে মাওলানা ও রুশো-র মতো আকর্ষণীয় ও গুরুত্বপূর্ণ ক্যারেকটারদের যথাযথ মূল্যায়ন করা হতো। তা না করে যেভাবে শেষ করা হয়েছে তাতে হয়তো বইয়ের আকৃতির লাগাম টানা গেছে, কিন্তু সবগুলো ক্যারেকটারের প্রতি সুবিচার হয়নি। তাছাড়া নায়ক-নায়িকার মধ্যে প্রেম গড়ে ওঠার বর্ণনাগুলোও বইটির শুরুর দিকে তৈরি হওয়া আপিলের মান রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে বলে আমার মনে হয়েছে। ঐ জায়গাটায় দারুণ মুন্সিয়ানার পরিচয় দেয়ার সামর্থ লেখকের যে আছে- তা উপন্যাসটির শুরুতেই বোঝা যায়। তবে, শেষ দিকে মেজর এন্ড্রু ও জাপানি বংশোদ্ভূত মার্কিন সিক্রেট এজেন্ট শিমুজির বদলে যাওয়ার বর্ণনা- বিশেষ করে শিমুজির কথা ও শেষ দৃশ্যে তার কর্মকান্ড চোখে পানি নিয়ে এলো!
সবশেষে বলবো, জনাব লতিফুল ইসলাম শিবলী আমাদের বর্তমান সময়ের অন্যতম সেরা লেখকদের একজন। অন্তত তার মধ্যে সেই সক্ষমতা ও দক্ষতা যে আছে তাতে আমার কোনো সন্দেহ নেই। তাই আশা করবো- তিনি তার মহান চেতনা ও কলমের তুলি দিয়ে আরো বেশ ক’টি এমন মাস্টারপিস উপহার দিয়ে বাংলা সাহিত্য কে সমৃদ্ধ করে যাবেন যে আমরা গর্ব করে বলতে পারবো- “লতিফুল ইসলাম শিবলী কোনো বিশেষ গোত্রের লেখক নন; তিনি সবার, তিনি এই বাংলার, তিনি বিশ্বের সবার!….”
সর্বোপরি, লেখকের দীর্ঘ ও শান্তিময় জীবন কামনা করে শেষ করছি। সেইসাথে এই আবেগি লেখাটা যদি কাউকে কষ্ট দিয়ে থাকে তাহলে তার নিজগুণে ক্ষমা করে দেয়ার আপিল জানাচ্ছি। আর অবশ্যই লেখাটা বড় হয়ে অনেকের বিরক্তি সৃষ্টি করার পরও পড়ার জন্য (যদি কেউ আদৌ পড়েন আরকি!) সকলকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

আবদুল মালেক

Article link

 

পাঠক প্রতিক্রিয়া – ৭৩

কিছুদিন আগে চরম হতাশায় দরুন জীবনের মায়াই যখন ক্ষীণ হয়ে আসছিলো তখন ফোন করে সব শুনে Rifat
ভাই বললো- তোর এই সময়টাতে এখন শুধু এই একটা বই’ই যায় সেটা ‘আসমান’। ছোটবেলা থেকেই আমার বই পড়ার প্রতি একটা আলাদা ঝোক ছিল। তার উপরে এমন কথা শুনে খুব দ্রুততার সাথেই বইটি সংগ্রহ করেছিলাম।
‘আসমান’ পড়ে আপনার প্রতি আমার আসমানসমই ভালবাসা জন্মেছিলো Latiful Islam Shibli ভাই। ক্ষুদ্রতর ভাবে হলেও বেচে থাকার এক অদম্য সাহস ‘আসমান’ আমাকে দিয়েছে। বেস্টসেলার বই যে এরকমই হয় সেটাও বুঝেছিলাম। সারাজীবন আপনার লেখা গান জেমস, মাইলস আর বাচ্চু ভাইয়ের কন্ঠে শুনে বড় হয়েছিলাম আর এখন আপনার গানের চেয়ে বেশি মুগ্ধ করেছে আপনার বই। এবারের বইমেলা থেকে ‘ফ্রন্টলাইন’ বইটি সরাসরি আপনার হাত থেকে নেওয়ার জন্য মুখিয়ে আছি!

Zia H Nur

Article link

 

পাঠক প্রতিক্রিয়া – ৭৪

খুঊব ছোটবেলা হতেই বই পড়তে শুরু করলেও আমি কখনোই বইয়ের রিভিউ লেখি না। আম্মু বলেন, ‘ কি পড়লে তুমি? যদি না একটা বই পড়ে রিভিউ লিখতে পারো?’ আমি অনায়াসে হেসে বলি, ‘ কি আম্মু! সবাই কি তোমার মতো ডায়রিতে বা টাইমলাইন তৈরি করে বইয়ের রিভিউ দেবার জন্য? তাছাড়াও আমি ব্যস্ত মানুষ। একাডেমিক পড়াশোনাতেই সময় পাই না, বইয়ের রিভিউ কখন লিখবো?’ আম্মু বলেন, ‘ তুমি একটা বই হতে কি পেলে সেটাই যদি নিজের মতো লিখতে না পারো বই পড়ে ফায়দা নেই।’ তারপরে আর কথা বাড়াই না দুজনের একজনও! একেবারে ঝুম নিরবতা নেমে আসে আমাদের মাঝে। এখন রাত ১ টা বেজে ১ মিনিট। ঘুম আসছে না। আসমান গতকাল পড়ে শেষ করেছি। বারবারই মনে হচ্ছে আসমান নিয়ে কিছু না লিখলে দারুণ বেইনসাফি হয়ে যাবে সাহস করে তাই টাইপ করতে বসা! কিন্তু যোগ্যতা আসলেই বলছে, ‘ জান্নাত চৌদ্দ হাত দূরে বসে বসে দেখে যাও শুধু। তবুও শত দ্বিধা ও দ্বন্দ্ব ঝেড়ে লিখতে বসলাম। লোকে বলে, ” নির্বোধের সাহসের অভাব হয় না।” একজন নির্বোধ ও অজ্ঞ মানুষ আমি কেন সাহসী হবো না?
.
বর্তমান সময়ে যেসব লেখক এই জেনারেশনটাকে পথ দেখাতে পথিক নবী হয়ে এসেছেন তাদের মাঝে একজনের নাম অহরহই উঠে আসে। আমি তাকে চিনি ২ বছর যাবত। আমার এক কাছের মানুষ তার খুঊব প্রতি খুঊবই অনুরক্ত ছিলেন। এবং যখনই আমাদের মাঝে লেখক শ্রেণী নিয়ে কথা উঠতো ” Latiful Islam Shibli
” যেন একটা মাস্ট সেয়িং নেইম ছিলো তার মুখে। তার বেশ কিছু বই প্রকাশিত হলেও আমার তার সাথে পরিচয় ফেইসবুকেই। কিন্তু আজ একজন পাঠিকা হিসেবেই আলোচনা করবো বইয়ের ভালো লাগা মন্দ লাগা নিয়ে।
.
খুঊব সম্ভবত মার্চের ১৫ তারিখে রকমারিতে অর্ডার করেছিলাম আসমান। ৩ কর্ম দিবসে তারা আমাকে বইটা হোম ডেলেভারী দিয়ে যায়। তারপরে নানান ব্যস্ততায় যেন আসমানকে প্রায় ৭ দিন ধরেই দেখতে পারিনি। আনপ্যাকড করা দূরে থাক। তারপরে ব্যস্ততা কমলে দেখলাম টেবিলের এক কোণে রকমারির সিল যুক্ত একটা প্যাকেট পরে আছে। তারপরে পড়ার টেবিলে বসে প্রতি রাতেই প্রায় ১ – ২ পেইজ সর্বোচ্চ ১০ – ২০ পেইজ পড়েছি। এ কী ঝড় বয়ে গেল পাতার পর পাতায়! এও কি সম্ভব! সোজা হয়ে সিরিয়াস ভঙ্গিতে আবারো প্রথম থেকে পড়লাম। এভাবেও লেখা যায় তাহলে! এতটা গভীর, এতটা বিস্তৃত করে! প্রায় অস্পৃশ্য- ছুলেই বিতর্কিত হবার ঝুঁকি, তবু কতটা বাস্তবতার নিরিখে তৈরি হয়েছে সময়ের সবচেয়ে সাহসী গল্প- আসমান।
.
দূষিত সামাজিক সম্পর্ক, কলুষিত ছাত্র রাজনীতি, মাদকের কড়াল গ্রাস, সন্ত্রাস, ধর্ম, ইসলামের প্রকৃত রূপ, রূপক ও স্বরূপের উন্মোচন, খিলাফতের ব্যাখ্যার শক্তি ও দূর্বলতা, জিহাদের সঠিক সংজ্ঞা ও তার বহুমাত্রিক ব্যবহার, মহান আল্লাহর প্রতি সঠিক ঈমান, ঈমানের পরীক্ষা ও তার জন্য ধৈর্য্যধারণ, আঘাতে-বিচ্ছেদে-করুণতম মুহূর্তেও ঈমানের প্রতি অবিচল থাকা, ঐতিহাসিক ঘটনাপঞ্জির সাথে সামঞ্জস্য রেখে উপন্যাসের চরিত্রগুলোর এগিয়ে চলা, শত্রুর হৃদয় জয় করে সারা পৃথিবীতে নিগৃহীত- ঠিকানাবিহীন হয়েও স্ত্রী-সন্তানের সাথে মিলনে সমাপ্তি ওমার রিজওয়ানের।
.
শুরুতেই ফ্ল্যাপ নিয়ে দু লাইন লেখি ..
” The fiction based on fact.” উপন্যাসের স্থান সত্য, কাল সত্য, ইতিহাস সত্য শুধু চরিত্র গুলো কাল্পনিক! এতো নাম ডাক লেখকের বইয়ের শুরুতেই ফ্ল্যাপে যদি এই লাইন চোখে পরে তবে এক বইপোঁকার মাঝে আশার পারদ কতটা চড়তে পারে এবং বইয়ের মাঝের বিষয় বস্তু নিয়ে বিস্তারিত এই রিভিউ।
.
ফ্ল্যাপের প্রথম অংশটা এরকম, “আমেরিকার কুখ্যাত জেল গুয়ানতানামো বে থেকে বিনা বিচারে ১২ বছর জেল খেটে মুক্তি পেয়েছে এক বাংলাদেশি। ওয়াশিংটন পোষ্টের এই খবরে চমকে গেছে বাংলাদেশ। পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় সাফ জানিয়ে দিয়েছে এমন সন্ত্রাসীর দায়িত্ব বাংলাদেশ নেবে না। আমেরিকান আর্মির কার্গো প্লেন তাকে ফেলে গেছে আলবেনিয়ার তিরানা বিমান বন্দরে। ট্রাভেল ডকুমেন্টহীন দেশহীন মানুষটাকে পৃথিবীর কোনো দেশ রাজনৈতিক আশ্রয় দেয় না। রিফিউজি স্ট্যাটাস নিয়ে তাকে থাকতে হবে রেডক্রসের শেল্টারে।
মানুষটা এখন কোথায় যাবে?
” চেনা সব দরজা বন্ধ হয়ে গেলে, একটা অচেনা দরজা খুলে যায়,
জীবন বন্দি হয়ে গেলে সেটা জীবনকে ছাপিয়ে যায়,
সেই জীবনের গল্প জীবনের চেয়েও বড় হয়ে যায়…”
এই লেখাটুকু নিয়ে শেষে কথা বলবো তার আগে সংক্ষেপে অল্প করে বইয়ের কাহিনী লিখি..
.
গল্পের শুরুটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া একজন আধুনিকমনা, মেধাবী, প্রেমে প্রতারিত, আত্মহত্যার পথ থেকে ফিরে আসা, প্রচণ্ড হতাশায় বিপথগামী, নেশাসক্ত তরুণের সাথে আধুনিকমনা, প্রাজ্ঞ, ধীরস্থির, ইসলামী দার্শনিক, উদারমনা একজন স্থানীয় মসজিদের ইমামের কথোপকথনের মাধ্যমে। পরবর্তীতে দুটি ভাগে গল্প এগিয়েছে। প্রথম ভাগে, স্বদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র ওমারের এক আকাশ স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের অনবদ্য চিত্র। সহপাঠী ও সাময়িক সময়ের প্রণয়িনী লামিয়ার ঝড়ো সম্পর্কের ভাঙা-গড়ার গল্প। যে লামিয়াকে একদিন নাম দিয়েছিল মাটি, সে লামিয়ার প্রতারণায় জীবনের অন্ধকার অংশের শুরু হয় গল্পের মূল চরিত্র ওমারের। এ সময়ে তাকে মায়ের অকুন্ঠ সমর্থন ও ভালোবাসাই প্রেরণা যোগায়। ইমাম সাহেবের দার্শনিক বিশ্লেষণে তার ইসলামের প্রতি আগ্রহ প্রতিষ্ঠিত হয়। আল্লাহর প্রতি ঈমান সুদৃঢ় হয়।
দ্বিতীয় ভাগে তাবলীগের সাথী হয়ে তাকে পাকিস্তান সফরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সত্যিগুলোর মুখোমুখি হতে হয়। তালেবান শাসন, ইসলামের শক্তি ও ভ্রান্ত ধারণার সাংঘর্ষিক অবস্থান, খিলাফত প্রতিষ্ঠায় স্বীয় ধর্মের অনুসারীদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র জিহাদ, মৃত্যুর মুখ হতে ফিরে আসা এবং অমোঘ সত্যের উপলব্ধি- ‘যে মানুষ মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে কলেমায়ে তৈয়্যেবা সশব্দে পাঠ করে চলেছে, আমি তাকে হত্যা করতে পারি না।’ এ ভাগে এসে আসমার সাথে প্রণয় ও অত্যন্ত প্রতিকূল পরিবেশে পরিণয়- আসমাকে ওমার কবিতায় ঘোষণা করে ‘আসমান’ বলে।
অত্যন্ত সতর্কতার সাথে গুয়ান্তানামো বে কারাগারের নারকীয় অত্যাচারের বর্ণনাকে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। দেশে থাকতে নেশাগ্রস্ত সময়ের বর্ণনা বরং অনেক প্রাঞ্জল। এর প্রয়োজন ছিল। নিষ্ঠুরতায় নয়, ওমারকে মানুষ খুঁজে নেবে ভালোবাসায়, প্রেমে- এটা একটা অবশ্যম্ভাবী চাওয়া পাঠকের-লেখকেরও! এটিই সম্ভাব্য সমীকরণ। সমাপ্তির অংশে আরেকটু সময় কাম্য ছিল। এ বিশাল পৃথিবীতে একজন ঠিকানাবিহীন মানুষের প্রতি সামাজিক আচরণের বহুমাত্রিকতা অনুপস্থিত ছিল। তবে অনুতপ্ত নও মুসলিম জাপানি গুপ্তচর শিমুজির ওমারের প্রতি আত্মসমর্পণ এর অভাব অনেকটা দূর করেছে।
সাহিত্যে সুফিবাদের সময়কালকে বাংলা সাহিত্যে মধ্যযুগ নামে অভিহিত করা হয়েছে। আমরা পেয়েছিলাম হাফিজ, ওমর খৈয়ামসহ পারস্য সাহিত্যের দিকপালদের রচনাবলী। আধুনিক সাহিত্য বহুমাত্রিকতায় এগিয়ে চলেছে কিন্তু সুফিবাদ এড়িয়ে গেছে অনেকটা প্রকাশ্যেই। এ রচনার দ্বারা সুফি সাহিত্যের অপ্রকাশিত লড়াই এর সূচনা হলো।
সম্ভব হলে আমি স্কুলগুলোতে নবম-দশম শ্রেণির ছাত্রদের জন্য এ বইটিকে অবশ্য পাঠ্য করে দিতাম। গোঁড়া মুসলিম উম্মাহ্ মুক্তি পাবে যদি অন্তরে অস্পষ্ট ব্যাখ্যার ধর্ম নয়, নর-নারীর প্রেম নয়, জান্নাতের লালসা নয়, ভুল নেতৃত্বের খিলাফত নয়, ক্রোধ কিংবা অন্ধ আক্রোশ নয়, প্রতিশোধ নয়, সাময়িক সাফল্যের অহংবোধ নয়, অতি আবেগের দুর্বিনীত প্রকাশ নয়;
কেবল মহান আল্লাহকে অন্তরে ধারণ করে, হৃদয় আল্লাহর ঘর- এ সত্য নির্মোহ ভালোবাসায় গ্রহণ করে, যাপিত জীবনের সকল ঘাত-প্রতিঘাতকে সহজভাবে গ্রহণ করে, নিজেকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে, জিহাদের জন্য সর্বদা নিজেকে তৈরি রাখে- জিহাদের স্বরূপ উম্মোচনে নিজের যৌক্তিক অবস্থান নির্ণয়ে অনুসন্ধানী হয়- সেই-ই খলিফা ওমার- ওমার রিজওয়ান! কিংবা খালিদ বিন আব্দুল্লাহ! অথবা, অনুতপ্ত জাপানিজ গুপ্তচর শিমুজি, নেশার মোহভঙ্গ তরুণ রুশো…
.
পুরো কাহিনী সংক্ষেপ পড়ার পর যারা বইয়ের নামকরন নিয়ে চিন্তিত তাদের জন্য সহজ করে দিই। আসমাকে ভালেবেসে আসমান বলে ডাকতো ওমার।
.
ব্যক্তিগত মতামত ~
১) আসমার সাথে কথা বলবার সময় কোরআনের সুরা আর আয়াত নম্বরের রেফারেন্স আগে তুলে দেয়াটা ভালো লাগেনি। এখানে শুধু আয়াতটা পড়ে শোনানোর পর নিচে ছোট্ট করে সুরার নাম আর আয়াত লিখে দিলে ভালো লাগতো। যে জিনিস বক্তৃতায় ভালো লাগে তা স্বামী স্ত্রীর কথোপকথনে ভালো লাগে না।
২) বই থেকে সরাসরি একটা অংশ তুলে দিচ্ছি,
“আসমা দুই হাতে চেপে ধরেছে ওমারের পিঠ। তার চুলের মধ্যে ডুবে আছে ওমারের নাক, গভীর শ্বাস টেনে ফুসফুস ভরে নেয় তার চুলের গন্ধ। ডান হাত দিয়ে আসমার কানের ওপর থেকে চুলগুলো সরিয়ে ফিসফিস করে নতুন শেখা ফারসিতে বলে—
‘আমি কোনোদিন কবিতা লিখিনি, জীবনের প্রথম কবিতাটি আপনার জন্য লিখেছি।’
ওমারের মুখে ফারসি শুনে ঝট করে আসমা আলিঙ্গন ছেড়ে মুখোমুখি দাঁড়াল, অবাক বিষ্ময়ে চকচক করছে ওর সবুজ চোখ।
‘এভাবে তাকিয়ে থাকলে আমি ফারসি ভুলে যাব।’
লজ্জা পেয়ে আবার ওমারকে জড়িয়ে ধরে মুখ লুকায় ওর বুকে।
ওমার ওর কানের কাছে ফিসফিস করে ফারসিতে আবৃত্তি করল—
‘যখন আমি ঘরে থাকি বুকে তুলে রাখি
যখন আমি বাইরে থাকি মাথায় তুলে রাখি,
তাছাড়া আর রাখব কোথায়?
হয় না সংকুলান!
আমি তোমার একলা পাখি,
তুমি আসমান।’
.
পাখি আর আসমানের সম্পর্কটা বইয়ের ভেতর থেকে জেনে নিতে হবে। ওপরে যে আবহটা তৈরী করেছেন লেখক সেখানে জাষ্ট এ পিঞ্চ অফ সল্ট শর্ট। ঐটুকু হলে এই একটা প্যারা পুরে বইয়ের সবকিছু কাভারআপ করে দিতো।
.
তারপরে –
৩) বানান ভুল নিয়ে দুঃখ করার কিছু নেই। আমাদের দেশে এই জিনিসটা শুধরাবে এমন আশা ক্ষীণ। তবুও যখন একটা বইয়ের পুনঃপুনঃ মুদ্রন আসে তখন আশা করাই যায় ভুলগুলো শুধরে নেয়া যাবে।
৪) বর্তমান লেখকদের গুছিয়ে শেষ করা একটা লেখা পড়লাম অনেকদিন পর। তাড়াহুড়ো করে শেষ করার যে প্রবণতা বর্তমান লেখকদের মাঝে আছে তার বাহিরে গিয়ে ভালো লাগলো বইটি।
৫) পুরে বইতে আক্ষেপ একটাই আসমাকে লেখক ভিজ্যুয়ালাইজ করানোর চেষ্টা করলো না। আসমার ব্যক্তিত্বকে যেভাবে গেঁথে দেয়া হয়েছে সেখানে নীল বোরখায় সবুজ চোখের এই আফগান মেয়েটাকে ওমারের পয়েন্ট অফ ভিউ থেকে একবার ভিজ্যুয়ালাইজ করালে দারুন লাগতো। অবশ্য বিয়ের রাতে ঘোমটা ফেলে আসমাকে বর্ণনা করার একটা প্রয়াস ছিলো তার কালো চুলগুলো সৌন্দর্যের কাছে হেরে গিয়ে সোনালী রং ছুঁইছুঁই করছে। জাষ্ট আরেকটু দরকার ছিলো। একটা আক্ষেপ থেকেই গেলো। প্রচ্ছদেও আসমাকে ঘোলাটে দেখানো হয়েছে। এই আক্ষেপটাই আসমার প্রতি আকর্ষনটা ধরে রেখেছে।
.
এবার ফ্ল্যাপটা নিয়ে শেষ দুলাইন বলি। ফ্ল্যাপটা বইয়ের ভেতরের কোনো কিছুকেই রিলেট করলো না। বই যেখানে শেষ হলো ফ্ল্যাপটা সেখানকারই। ফ্ল্যাপটা পড়ার পর আমি জাষ্ট ভেবে নিয়েছিলাম তিরানা বিমানবন্দর থেকে শুরু হবে গল্প। শুরু হবে একটা সার্ভাইভালের গল্প। ধীরে ধীরে খোলাসা হবে অতীত। কিন্তু ভেতরে কি পেলাম? কি দেখলাম? কি কিনলাম? আর কি পড়লাম? অসাধারণ! মোট কথা, ১৫২ পৃষ্ঠায় এ জমিনে আসমান নেমে এসেছে। আর আমি আমার রক্তের অনেক দূষণকে চিনে গেছি।

Faria Jannatul Shiheentaa

Article link

 

Related posts